আলোচিত
ঢামেক জরুরি বিভাগের টিকেট ১০ টাকা হলেও ট্রলি ভাড়া ২০০!

আলোচিত বার্তা : ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতি ঘণ্টায় গড়ে ৬০ জন রোগী আসছেন। মুমূর্ষু ও গুরুতর আহত এসব রোগীকে সিএনজি, অ্যাম্বুলেন্স বা গাড়ি থেকে নামিয়ে ট্রলিতে করে চিকিৎসকের সন্ধানে ছুটছেন স্বজনেরা। ক্যাজুয়ালটির রোগী ছাড়া নিউরো, প্রেগন্যান্সির রোগীকেও সরাসরি ওয়ার্ডে পাঠিয়ে দিচেছন সংশ্লিষ্ট চিকিৎসক। গত ৩ জুন ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সরেজমিনে গিয়ে এমন দৃশ্য দেখা যায়।
এই হাসপাতালের জরুরি বিভাগে প্রতিদিন গড়ে দেড় হাজার রোগী আসেন।
রোগী ও আত্মীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, জরুরি বিভাগে রোগী নিয়ে এসে দাঁড়িয়ে থাকলেও অনেক সময় সিরিয়াল পাওয়া যায় না। রোগী দাঁড়িয়ে থাকলেও গেটের কাছে ট্রলি থাকে না। কারণ, রোগীর তুলনায় ট্রলি কম। ট্রলিম্যানরা ট্রলিতে রোগী নিলে সর্বনিম্ন ১০০ টাকা থেকে শুরু করে ২০০, ৩০০ এমনকি ১০০০ টাকা পর্যন্ত নেয়। রোগী বুঝে তারা টাকা চার্জ করে।
এ ছাড়ার তাদের বিরুদ্ধে দালালির জোরালো অভিযোগ রয়েছে। তারা রোগীকে ট্রলিতে নিয়ে যাওয়ার সময়ই রোগীর আত্মীয়কে বলে, এখানে এই রোগের চিকিৎসা নেই। অমুক হাসপাতালে যান। এরপর ওয়ার্ড পর্যন্ত রোগী না গিয়েই আবার বের করে সিএনজিতে ওঠায়। এখানে আগে টিকিট না কাটলে যত মুমূর্ষুই রোগী হোক না কেন, দেখা হয় না বলে অভিযোগ করেন রোগীর আত্মীয়রা।
চাচাকে নিয়ে এসেছেন নোয়াখালীর রামিসা বেগম। তিনি বলেন, ‘আমার চাচার ব্রেন স্ট্রোক হয়েছে। প্রথমে নোয়াখালী সদর হাসপাতালে নিয়ে যাই, তারা ঢাকা মেডিক্যালে পাঠাইছে।’
সেখানে রামিসার সঙ্গে আসা লোকজন প্রথমে জরুরি বিভাগে দেখিয়ে পরে ওয়ার্ডে নিয়ে গেলেন চাচাকে। জরুরি বিভাগে এক্সরে মেশিন নষ্ট আছে প্রায় এক মাস ধরে। কোনও রোগীর এক্সরে করতে হলে তাকে নতুন বিল্ডিংয়ের নিচতলায় নিয়ে যাচ্ছেন স্বজনরা।
জরুরি বিভাগের সামনে দেখা যায়, অ্যাম্বুলেন্স, সিএনজিচালিত অটোরিক্সা এবং রিকশায় করে যাত্রীরা আসছেন। বেশি মুমূর্ষু রোগীদেরই শুধু ট্রলিতে তোলা হচ্ছে। অনেক রোগীকে দেখা যায়, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে স্বজনকে ধরে হাঁটছেন। কেন ট্রলি নিচ্ছেন না জানতে চাইলে এক রোগীর স্বজন সুজন আকরাম বলেন, ‘এখানে টিকেট কাটতে লাগে ১০ টাকা। আর ট্রলি ছুঁলেই ২০০। এটা কোনও সিস্টেম বলেন!’
আসমা খাতুন প্রেগন্যান্ট। তাকে অ্যাম্বুলেন্সে করে পরিবারের সদস্যরা এনেছেন। তখন দুপুর ১২টা। গনগনে রোদ। এরই মধ্যে ট্রলি নিয়ে পুরো এক ঘণ্টা অ্যাম্বুলেন্সের পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন ট্রলিম্যান। আসমার ভাই মো. আসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘রোগীর অবস্থা ভালো না। ট্রলিম্যানকে বলছি, ১০০ টাকা নিতে, সে ৫০০ টাকা দাবি করছে। তাই নিচ্ছে না।’
পরে ৫০০ টাকাতেই ওই রোগীকে ভেতরে নিয়ে যান।
ছেলের মাথায় টিউমার ধরা পড়ে খুলনায় ১৫ দিন আগে। সেখানকার হাসপাতালে রোগীর অনেক সিরিয়াল তাই ঢাকায় এনে ছেলের পাশে দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করছিলেন মা নাজিফা বেগম। প্রায় দুই ঘণ্টা অপেক্ষার পর ছেলেকে ওয়ার্ডে ভর্তি করার সুযোগ পান তিনি।
হাসপাতালের সরদার মো. স্বপন মিয়া বলেন, ‘এখানে ট্রলি আছে ২০টি। ট্রলিম্যান আছে ২০ জন। তবে সবাই বেতন পায় না। আট ঘণ্টা করে তারা ডিউটি করে। সরকারি আছে পাঁচ জন, বাকিরা বেসরকারি। ট্রলিম্যানরা কোনও রোগীর ব্যাপারে চুক্তি করে না। রোগী যা দেবে তাই নেয়। রোগী কোনও কমপ্লেইন করলে পুলিশে দেবো আমরা।’
তিনি বলেন, ‘সরকারের উচিত দ্রুততম সময়ে বেসরকারি যারা তাদের সরকারি করে নেওয়া। তাহলে রোগীরা আরও ভালো সেবা পাবে।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের আবাসিক সার্জন ডা. মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘রোগীরা যদি আমাদের প্রতি ফ্যামিলিয়ার না হয়, আমাদের কাজ করতে কষ্ট হয়। তারা যেন আমাদের প্রতি আন্তরিক হয়। একজন রোগী খারাপ ব্যবহার করলে এর প্রভাব পরবর্তী রোগীদের ওপর পড়ে। আমি অমুক, দিলো ধমক; আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, দিলো ধমক; আমি লালবাগ, দিলো ধমক। একজন চিকিৎসক কতজনের ধমক নেবেন? সবার সার্বিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে একটা সুস্থ পরিবেশ ও সুস্থ চিকিৎসা ব্যবস্থা সম্ভব।’
তিনি বলেন, ‘যেকোনও ডিপার্টমেন্ট কয়েকটা বিষয়ের ওপর চলে। লোকবল ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। লজিস্টিক সুবিধা তো লেটেস্ট ফ্যাসালিটি থাকলে লেটেস্ট সেবা দিতে পারবো। আমাদের এখানে এক্সটেনশন (নতুন রুম) হচ্ছে সেখানে রোগীদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করবো। যেকোনও কাজের ক্ষেত্রে ১৫-২০ ভাগ এরর থাকবেই। তারপরও আমরা চেষ্টা করি ৫-১০ ভাগ এরর রাখতে। কিছু সিস্টেমের শিকার আমরা। যেমন ইন্সট্রুমেন্টগুলো ঠিকমতো পাওয়া যায় না। সিস্টেমের জটিলতার কারণে এটা সম্ভব হয় না। ট্রলির কথা যদি বলি চাকাগুলো মজবুত, কিন্তু এর ট্রে পাতলা। যখন টেন্ডার দেয় তখন টেন্ডার পাওয়ার জন্য ব্যবসায়ী কম দাম উল্লেখ করে। ফলে, আমাদের যে ট্রলি পাওয়ার কথা সেই ভালো কোয়ালিটির ট্রলি পাই না।’
ডা. মো. আলাউদ্দিন বলেন, ‘১০০ ভাগ সরবরাহ ফ্রি দেওয়া সম্ভব না। কারণ একেক রোগীর ডিম্যান্ড একেক রকম। অনেক সময় রোগীর জন্য এমন সুতা লাগবে যা হয়তো মাসে একজন-দুজন রোগীর লাগে। এক্ষেত্রে আমরা চাইলেও সেই সুতা রাখতে পারি না। যার যা ডিউটি ঠিকমতো করে সেটার ব্যবস্থা করেছি। আমাদের এখানে বেশিরভাগ সময় কাজ করতে করতে ট্রেইনড হচ্ছে। চিকিৎসকরা বিভিন্ন ট্রেনিং নিয়ে আসে। সিস্টাররাও ট্রেনিংপ্রাপ্ত। ট্রেনিং ছাড়াই আসছে ওয়ার্ড বয়, ট্রলিম্যান— এরা। আপনার যদি মানসিক ডেভেলপ নিজে না করতে চাইলে কোনোভাবেই সম্ভব না।’
তিনি বলেন, ‘যারা রিটায়ার্ড করছেন তাদের রিপ্লেস হচ্ছে না। এ কারণে আমাদের এখানে জনবল সংকট প্রকট আকারে রয়েছে।’
রোগীদের অভিযোগ প্রসঙ্গে ডা. মো. আলাউদ্দীন বলেন, ‘রোগীকে যথাযথ স্থানে পাঠাতে হলে তার দ্রুত চিকিৎসা শুরু করতে টিকিট করাটা জরুরি। ১০ টাকার টিকিট মুখ্য বিষয়টা। টিকেট ছাড়া পাঠালে রোগীর সেবা হবে না। তবে আমরা চেষ্টা করি নিয়মগুলো শিথিল করে রাখতে।’