
বার্তাবাহক ডেস্ক : কুয়েতের আদলতে শহিদ ইসলাম পাপুলের সাজা হয়েছে। কিন্তু দেশে তার সংসদ সদস্য পদ বহাল আছে। পিকে হালদার কয়েক হাজার কোটি টাকা নিয়ে পালিয়েছে। যারা তার কাছ থেকে ঘুষ নিয়েছে তাদের দায়িত্ব বদল করেই ‘দুর্নীতি দমন’ করা হচ্ছে!
প্রশান্ত কুমার হালদারকে (পিকে হালদার) ধরে আনতে এখন দুদক পুলিশ সদর দপ্তরের মাধ্যমে ইন্টারপোলে রেড নোটিশের আবেদন করেছে। রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে বলে জানান দুদকের প্রধান আইনজীবী। কিন্তু সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাচার করে পালানোর সময়ই তাকে কেন আটকানো গেল না?
এখন পিকে হালদারের আত্মীয়দেরও আসামি করেছে দুদক। দুজন সহযোগী এরইমধ্যে আদালতে জবানবন্দি দিয়েছে। তার সংশ্লিষ্টদেরও চিহ্নিত করা হচ্ছে। কিন্তু যারা পিকে হালদারের কাছ থেকে নিয়মিত ঘুষ নিয়েছে তাদের বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে?
পিকে হালদারের অনিয়মের সহযোগী হিসেবে আটক ইন্টারন্যাশনাল লিজিংয়ের সাবেক এমডি রাশেদুল হক আদালতে দেয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও পরিদর্শক দল পিকে হালদারের কাছ থেকে নিয়মিত পাঁচ থেকে সাত লাখ টাকা ঘুষ নিতেন। তাদের মধ্যে আছেন বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক নির্বাহী পরিচালক এস কে সুর ও বর্তমান নির্বাহী পরিচালক শাহ আলম। শাহ আলমকে এই ঘটনা প্রকাশের পর দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেয়া হয়েছে৷ আর কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
তবে বাংলাদেশ ব্যাংক বিষয়টিকে কতটা গুরুত্ব দিয়েছে তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরজুল ইসলাম বলেন, ‘‘নির্বাহী পরিচালক শাহ আলমকে সরিয়ে দেয়া হয়নি, পোর্টফোলিও পরিবর্তন হয়েছে। এটি একটি সাধারণ ঘটনা৷ জড়িত কিনা তা তো প্রমাণ সাপেক্ষ।’’
তিনি তদন্তের প্রশ্নে বলেন, ‘‘এখন আমরা যাচাই বাছাই করে দেখবো। আদালত থেকে জিএম পর্যায়ের কর্মর্তাদের নামের তালিকা চাওয়া হয়েছে। সবাই তো আর জড়িত না। অনেকে আবার অবসরে গেছেন৷ আমরা আইনগত পরামর্শ নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেব।’’
পাপুলের বিষয়ে আনুষ্ঠানিক তথ্য পায়নি সংসদ
এদিকে মানব পাচার ও অর্থ পাচারের মামলায় কুয়তের আদালতে লক্ষ্মীপুর-২ আসনের স্বতন্ত্র সংসদ সদস্য শহিদ ইসলাম পাপুলের চার বছরের কারাদণ্ড এবং ১৯ লাখ কুয়েতি দিনার জরিমানা হয়েছে। পাপুলের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারের মামলাও হয়েছে বাংলাদেশে। তার স্ত্রী, শ্যালিকা এবং কন্যাকেও আসামি করা হয়েছে। তার স্ত্রী সেলিনা ইসলাম সংরক্ষিত নারী আসনে সংসদ সদস্য।
তবে পাপুলের সংসদ সদস্য পদ এখনও বহাল আছে। সংসদে পাপুলের বিষয়টি আলোচিত হলেও তারা ‘অফিসিয়ালি’ কোন তথ্য না পাওয়ায় এখনো তার সংসদ সদস্য পদ বাতিলের প্রক্রিয়াই শুরু হয়নি বলে জানিয়েছে সংসদ সচিবালয়।
জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরিন শারমিন চৌধুরী জানান, ‘‘বাংলাদেশ পার্লামেন্টের রুলস অব প্রসিউিউর অনুযায়ী একটি ফরম্যাট আছে। সেই ফরম্যাট অনুযায়ী যারা আটক করেছেন তারা বা রায় হয়ে গেলে সেই আদালত অথবা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ওই ফরম পূরণ করে সংসদের স্পিকারকে জানাবেন। সংসদের স্পিকার এটা পাওয়ার পরে তার যা করার তা করবেন। কিন্তু স্পিকারের কাছে কাছে সেরকম কোনো ফরমাল ইনফরমেশন আসেনি।’’
আর দুদকের আইনজীবী খুরশীদ আলম বলেন, ‘‘পাপুলকে এখন ফিরিয়ে আনারও সুযোগ নাই। কারণ সে কুয়েতে আটক আছে। সে আপিল করবে। সাজা শেষ হওয়ার প্রশ্ন আছে।’’
নিষেধাজ্ঞা কাজে আসে না
কিন্তু পিকে হালদারকে ফিরিয়ে আনা কতটুকু সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, ইন্টারপোল তো রেড নোটিশ জারি করেছে। কিন্তু পাপুল পালাবার আগেই তার দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিলো দুদক। তারপরও কীভাবে পালালো?
অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম জানান, এ পর্যন্ত তারা ২৫-৩০ জনের দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছেন। কিন্তু তারা তো আর আটকাতে পারেন না। সেটা দেখার দায়িত্ব আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও ইমিগ্রেশনের।
তিনি বলেন, ‘‘সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কারো চলাচলে নিষেধাজ্ঞা দেয়া যায় না। আইনেও কোথাও নিষেধাজ্ঞা দেয়ার কথা বলা নাই। আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে পুলিশ ও ইমিগ্রেশনকে জানাই। আমরা নিষেধাজ্ঞা দিলেও তারা রিট করে তা বাতিল করিয়ে দেয়।’’ এনবিআর ও বাংলাদেশ ব্যাংকও এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা দেয় বলে তিনি জানান। কিন্তু কাজ হয় না।
পিকে হালদার এবং পাপুল দুইজনই দেশের বাইরে পালিয়ে যাওয়ার আগে সংবাদমাধ্যমে তাদের দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ হয়েছে। এ বিষয়ে খুরশীদ আলম বলেন, ‘‘আমরা তো সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখে কাউকে আটকাতে পারি না।’’
দুদকে এখন বিদেশে অর্থপাচারকারী ২৫ জনের বিরুদ্ধে তদন্ত হচ্ছে। এরমধ্যে সাবেক এবং বর্তমান সংসদ সদস্যও আছেন। কিন্তু তারা যদি পরিস্থিতি বুঝে দেশের বাইরে চলে যান তাহলে বাস্তবে কিছুই করার থাকবে না।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান মনে করেন, ‘‘প্রধানমন্ত্রী দুর্নীতি দমনে যতই জিরো টলারেন্সের কথা বলুন না কেন বাংলাদেশ ব্যাংক, পিকে হালদার এবং এমপি পাপুলের ঘটনায় এটা প্রমাণিত যে বাস্তবে দুর্নীতি দমনের অবস্থা আওয়াজেই যেন সীমাবদ্ধ। পিকে হালদারকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা দুর্নীতিতে জড়িয়ে পড়লেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে না।’’
তবে তিনি মনে করেন, কারো বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ না থাকলে তার দেশ ত্যাগে বাধা দেয়া যায় না। কিন্তু তার প্রশ্ন, ‘‘দুদকের মামলা ও দেশ ত্যাগে নিষেধাজ্ঞার পরও পিকে হালদার কীভাবে পালালো? আর এমপি পাপুলের সাজার বিষয়টি দূতাবাস বা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় কি অফিসিয়াললি স্পিকারকে জানাতে পারে না? এখানে আন্তরিকতার অভাব স্পষ্ট।’’
সূত্র: ডয়চে ভেলে